পৃথিবীকে ঠিকে রাখার পিছনে অবদান রয়েছে পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষরাজি ও বিভিন্ন প্রকারের জড়, জীব আর অনুজীবের। বৃক্ষ যেমন প্রাণীকুল রক্ষার্থে সহায়তা করে ঠিক তেমনি প্রতিটি প্রাণীও মানুষের উপকার করে থাকে কোন না কোন উপায়ে। এদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র এক প্রাণী হচ্ছে মৌমাছি।
গবেষনা ও বিভিন্ন তথ্যে উঠে এসেছে, মৌমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের কারণে গাছে ফুল ফোটে, ভালো ফল হয়। মৌমাছির মতো কীটপতঙ্গ না থাকলে গাছে ফুল ফুটত না, ফলও হতো না। অধিকাংশ বনজ উদ্ভিদে পরাগায়ন ঘটায় মৌমাছিরাই। মৌমাছিরা প্রধানত ফুলের পরাগায়নে সহায়তা করে বনজ, ফলদ এবং কৃষিজ ফসলের ক্ষেত্রেও। একদিকে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে যেমন সহায়তা করে অপরদিকে মধুও আহরণ করে যা মানব জাতিকে তা উপহার দেয়।
মৌমাছির সাধারণত দুটি পাকস্থলি থাকে আর দ্বিতীয় পাকস্থলিতেই জমা রাখে মধু। পাকস্থলীতে থাকা অবস্থায় তা নষ্ট হয় না। জানা গেছে মৌমাছি যখন চাকে ফেরে তখন জমিয়ে রাখা সেই মধু মুখ দিয়ে উগড়ে দেয়। ফূল ও ফলের নির্যাস থেকে সংগৃহীত উচ্চ ঔষধি গুণসম্পন্ন এই ভেষজ তরল খাদ্যের নাম মধু হিসেবে অতি পরিচিত বাংলাদেশে।
গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে পরিবেশ বান্ধব এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি মানুষের নানাবিধ উপকার করে থাকে। এই উপকারি মৌমাছির প্রতি সরকারি এবং বেসরকারিভাবে যদি গুরুত্ব না দেয়া হয় তাহলে এক সময়ে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে মৌমাছি বিলুপ্ত হলে নানান তথ্য উপত্যকা আর গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে বিলুপ্তির উপক্রম দেখা দিবে মনুষ্য বসাবসের ক্ষেত্রেও। তাই উপকারী এই ক্ষুদ্র প্রাণী মৌমাছিকে বাঁচিয়ে রাখার কোন বিকল্প নেই। যদিও মৌমাছিদের আয়ুষ্কাল আবহাওয়ার তারতম্যে এবং অনুকূল পরিবেশের উপর অনেকটা নির্ভর করে। এছাড়াও মৌমাছির আয়ুষ্কাল বা জীবনকাল তাদের প্রকারভেদ এবং কাজের উপরও নির্ভর করে ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত তিন শ্রেণীর মৌমাছি রয়েছে। এদের মধ্যে রানি মৌমাছি, কর্মী মৌমাছি এবং পুরুষ মৌমাছি। সুস্থ একটি রানী মৌমাছি উপযুক্ত পরিবেশে সাধারণত ২ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। রানি মৌমাছি সাধারণত ডিম পাড়ার কাজ করে থাকে। কর্মী মৌমাছি গ্রীষ্মকালে সাধারণত ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচে। শীতকালে এদের জীবনকাল বেড়ে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। ওরা চাক তৈরি, মধু সংগ্রহ এবং চাক রক্ষায় কাজ করে থাকে। পুরুষ মৌমাছি মৌমাছির জীবনকাল সাধারণত কয়েক সপ্তাহ থেকে দুই মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারা শুধুমাত্র রানীর সঙ্গে মিলন করে থাকে এমনকি মিলনের পর মারাও যায়। গবেষকদের মতে আরও জানা গেছে গ্রীষ্ম ও বসন্তকাল ছাড়া বাকি মৌসুমে পুরুষ মৌমাছিরা সাধারণত অলসে সময় কাটায়। তবে অতিরিক্ত শীতে মৌমাছি তাদের জমা রাখা খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের নিকলী, বাজিতপুর, অষ্টগ্রাম, ইটনা মিঠামইনসহ একাধিক উপজেলা ও তৎসংলগ্ন জেলার বিভিন্ন হাওর অঞ্চলের বিক্ষিপ্ত স্থানে সরিষার আবাদ লক্ষ্য করা যায়। সরিষার জমিকে দূর থেকে মনে হয় যেনো হলুদ বর্ণের ফুলের ন্যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সাজানো লীলাভূমি। পরিতাপের বিষয় এই মৌসুমে হাওর অঞ্চলের সরিষার ফূলে তেমন একটা মৌমাছির দেখা মিলছে না। তবে স্থানীয় কৃষক ও মৌয়ালদের আফসোসের ভাষ্য: সরিষা ক্ষেতে এখন আর আগের মতো দেখা মিলে না মৌমাছিদের। শোনা যায় না মৌমাছির মৌ মৌ শব্দের কোজন আর গুনগুন শব্দের গুঞ্জন। চোখে ধরা পড়ে না ঝাঁক বেঁধে চক্রাকারে আকাশ পানে ছুটে চলা মৌমাছির মনোরম দৃশ্যও। যদিও অনেক সময় আতংকের কারণও হয়ে দাঁড়াতো দলবদ্ধ মৌমাছি। অনেক সময়ে আক্রমণের খবরও মিলতো বিশেষ কারণে। এই ভয়েও অনেকে তাড়িয়ে দেয়।
কটিয়াদী উপজেলার মানিকখালী চাঁন্দপুর গ্রামের ভ্রাম্যমান মাওয়াল ইদু মিয়ার আফসোসের ভাষ্য: আগের মতো এখন আর মৌমাছির চাক পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও টুকি টাকি কোথাও মিলে তবুও মিলে না তেমন একটা মধুর পরিমাণ।
নিকলী জারইতলা রসুলপুর বাজারের প্রবীণ মিষ্টির কারিগর যতীন্দ্র চন্দ্র ঘোষের ভাষ্যমতে এখন আর মিষ্টির দোকানে আগের মতো মৌমাছিদের দেখতে পাওয়া যায়নি। মোমাছির পরিমাণ অত্র এলাকায় তুলনামূলক অনেকটা কমে গেছে বলেও তিনি জানান।
বাজিতপুর উপজেলার সরারচর বাজারের হোমিও এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডাঃ আশরাফুল ইসলাম আফসোসের সুরে কয়, আজকাল নানান ঔষধ তৈরির জন্যে সরিষার মৌসুমেও এলাকায় মধু পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। বাজারের বিভিন্ন ধরণের কোম্পানির মধুর উপর শতভাগ আস্তা রেখে ঔষধ তৈরি এখন জটিল হয়ে গেছে। এভাবে যদি মৌমাছি দিন দিন কমতে তাহলে নিশ্চিত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে পরিবেশ ও মানুষের জন্যে।
হাওর অঞ্চলের অসংখ্য কৃষকের সাথে কথা হলে জানা যায় বেশীরভাগেরই ধারণা নেই এই উপকারী মৌমাছির সুফল সম্পর্কে। বরং অনেকের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে।
উপকারী এ মৌমাছি সম্পর্কে একাধিক পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বনজ ও প্রাণীজ সম্পদ কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকতা এমনকি একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে কথা হলে তারা তাদের বিভিন্ন ধরণের বৈজ্ঞানিক যুক্তি উপস্থাপনের পাশাপাশি মধু আহরণকারী মৌমাছি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কেও আলোচনা করেন। এমনকি উপকারী মৌমাছি ও তার পুষ্টিগুণ মধুর নিয়ে পর্যালোচনা করেন।
প্রাথমিকভাবে গবেষণায় উঠে এসেছে অস্বাভাবিক আবহাওয়াজনিত তারতম্য ও ঋতু পরিবর্তনের বিষয়টি এর জন্যে প্রধান দায়ী। কখনো অতিরিক্ত গরম কখনোবা অতিরিক্ত ঠান্ডা। এছাড়াও বাতাসে অতিরিক্ত সীসার পরিমাণ বড়ে যাওয়া এবং অভয়ারণ্যে বাধাগ্রস্ত হওয়াটাও দায়ি বলে চিহ্নিত করেন। তথ্য মতে দেখা গেছে মধু সংগ্রহের নেশায় মৌচাকে মৌয়ালদের আক্রমণের প্রভাব। কৃষি জমিতে কিংবা ফূলে, ফলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ। অনেক এলাকায় দেখা মিলে মৌয়ালরা অতিরিক্ত পরিমাণে মধু সংগ্রহের নেশায় অবৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌমাছির লালন পালন করা। এতে বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি কুপ্রভাব পড়ে গ্রাম অঞ্চলে অদক্ষ লোকেরা যখন আগুন আর ধোয়ার আঁচ দিয়ে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে এ সময়ে অদক্ষরা মৌমাছি অগুনিত মৌমাছি মেরে ফলে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে হাওর এলাকায় বড় বড় গাছপালা গিলে খাচ্ছে ইটভাটা। বৃক্ষনিধন আর ইটা ভাটার কালো ধোঁয়া দূষিত করছে পরিবেশ। ফুলে ফলের মুকুলে বাধাও। খাদ্য সংগ্রহে জটিলতা। সকল পারিপার্শ্বিক অবস্থা এর জন্যে দায়ী। যে কারণে ২০১৮ সালে আইইউসিএনের ঝুঁকিগ্রস্ত প্রাণীদের রেড লিস্টেও দেখা যাচ্ছে প্রজাপতি আর ভ্রমরের মতো উপকারী পতঙ্গ বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির মৌমাছির দেখা মেলে। পাহাড়িয়া, ক্ষুদে ও খুড়েল। তুলনামূলক বড় গাছে ও দালানের কার্নিশে পাহাড়িয়া মৌমাছিরা চাক বাঁধে। খুদে মৌমাছিরা সাধারণত মানুষের নজরের অনেকটা আড়ালে বনজঙ্গলে আর ঝোপ ঝাড়ের ভেতরে ছোট গাছে চাক বাঁধে। এছাড়াও খুড়েল মৌমাছি বিভিন্ন ধরণের বড় গাছের কুঠুরিতে বাসা বাঁধে।
সচেতন মহলের ভাষ্যমতে, মধুর পরিমাণ উত্তর বঙ্গের সুন্দরবন এলাকাতে তুলনামূলক বেশি দেখা গেলেও মধু সংগ্রহকারী অসাধু মৌয়ালরা মৌচাক পরিপক্ক হওয়ার আগেই তা ভেঙ্গে ফলে। এতে প্রজনন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয় এবং মধুর পরিমাণও কমে যায়। এভাবে অপরিপক্ক মৌছাক একের পর এক ভাংতে থাকলে আর মৌচাকে তাড়া করে বেড়ালে অদূর ভবিষ্যতে এই সব এলাকা থেকেও মৌমাছি বিলিন হয়ে যাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
অনেকে আবার যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন শূধু মৌমাছিই নয় সাত রঙের প্রজাপতি, উপকারী ব্যাং, মাছ এমনকি গুইসাপসহ যে সকল উপকারী প্রাণী রয়েছে তাদের দিকে সরকারি বেসরকারিভাবে গুরুত্ব না দিলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।
জেলা কৃষি অফিস আবুল কালাম আজাদের সাথে কথা হলে জবাবে মৌমাছি পরাগায়নে সহায়তা করে এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বলে তার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে মৌসুমী কিছু ফসলের ক্ষেত্রে মৌবক্স তৈরি করে ফসলে পরাগায়ন রক্ষার উদ্যেগ নিতে যাচ্ছে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন। এতে করে মৌমাছির বংশবিস্তারেও অনেকটা সহায়ক হবে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আঃ হামিদের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক কাজী নাজমুল মাহমুদের সাথে মৌমাছিরা পরিবেশের ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা করে এবং জীব বৈচিত্র্যর ভারসাম্য রক্ষায় কতটা উপকারী এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি অধীনস্থদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। এই বিষয়ে তিনি ততটা অভিজ্ঞ নন বলেও দাবি করেন।
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. শেখ শাহীনুল ইসলামের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা হলে মধু আহরণকারী মৌমাছির পরিমাণ হাওর অঞ্চল থেকে কমে যাওয়ার জন্যে অনুকূল পরিবেশে বাধা, আবহাওয়াজনিত তারতম্য, অতি মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ এবং কৃত্রিম উপায়ে অসাধুরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যতিরেকে মধু সংগ্রহের জন্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে লালনপালনকেও অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন।
আপনার মতামত লিখুন :