হাওর অঞ্চল থেকে নিজেস্ব প্রতিবেদকঃ সিন্ডিকেটের বেড়াজালে আবদ্ধ করে প্রভাবশালীরা যুগে যুগেই সরকারি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। অসাধুদের এই সব অবৈধ কৌশলের কাছে সরকারও নিয়মিত হারায় প্রকৃত রাজস্ব। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই ধরণের কৌশলের সুযোগে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। অসাধুরা কোটিপতি বনে গেলেও সচরাচর সরকারি ইজারা মূল্যের তেমন একটা পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়নি। নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলার ন্যায় অধিকাংশ উপজেলার ইজারাধীন হাট বাজারগুলোতে এমন দৃশ্য বিদ্যামান। তুলনামূলকভাবে গ্রাম-গঞ্জের হাটগুলোতে অধিক পরিমাণে এ অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। সুকৌশলে করে থাকে প্রভাবশালী মহলের সুবিধাভোগীরা অবৈধ সিডিউল বানিজ্য। এমনি এক বাস্তবতা মিলে বাজিতপুর উপজেলার ঐতিহাসিক সরারচর হাট-বাজারকে ঘীরে। কয়েকশত বছরের ঐতিহাসিক এ হাট-বাজারের নামমাত্র ইজারা মূল্য নিয়েও সীমাহীন সমালোচনা দীর্ঘদিন থেকেই। এছাড়াও রয়েছে হাটের তদারকির বিষয় নিয়ে নানান সমালোচনা।
দেড় যুগের কাছাকাছি সময়ের সরারচর হাটের ইজারাদার ও বাজিতপুর উপজেলার আ’লীগের যুগ্ন-আহবায়ক মহিউদ্দিন আহমেদসহ স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের দেয়া তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে উঠে এসেছে অতীতে প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্র উপশাখা তেজখালী খালের তীরবর্তী একটি চর জেগে উঠার পরপরই সারাস পাখিদের আড্ডার স্থানে পরিণত হয় এলাকাটি। এ থেকে এর নাম করণ করা হয় সারারচর। পরবর্তীতে মুগল আমলে এর নাম করা হয় মোহাব্বতপুর। ব্রিটিশ আমলে শরৎগঞ্জ ও ইচ্ছাগঞ্জ বাজার নামে পরিচিতি পায়। এর পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ফতেহপুর। এ সময়ে খন্ড ভাগে বিভক্তের কথাও জানা গেছে। তবে প্রাচীন জনপদের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি ১৯১৫ সালে জমিদার এ্যাডভোকেট সতীশ চন্দ্র রায়ের নামে রেকর্ড হয়। তার কাছ থেকেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জায়গাটি একোয়ার করে। ১৯২০ সালে সরারচর নামে ইউনিয়নও স্থাপিত হয়। যদিও বাজারের মৌজাটি মজলিশপুর ও মিরাপুরেরি অবস্থিত। তথ্যমতে মুগল আমল থেকেই এ হাটের সূত্রপাত। তখন থেকেই স্থানীয়রা এ বাজারে সপ্তাহের একদিন গবাদি পশু পাখি কেনা বেচা করতেন। সর্বশেষ আ’লীগের প্রভাবে একচেটিয়াভাবে মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে স্থানীয় আ’লীগ নেতাকর্মীরা দেড় যুগ সময় ব্যাপী এ হাট ও বাজারটি থেকে সুবিধাভোগ করে। সুবিধা নিলেও হাটটির তেমন কোন উন্নয়নের লক্ষ্যে কোন ধরণের কাজ করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। ইজারা মূল্যেরও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। শুধু হাতিয়ে নিয়েছেন কারি কারি টাকা। জানা গেছে ১৯৭২ সালের দিকে সরকারিভাবে হাটটি পরিপূর্ণভাবে ইজারায় আসে। ইজারা হয় মূলত সরারচর বাজারের নামেই। যার অধীনে রয়েছে গরুর হাটও। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য আর কৌশলের কাছে ইজারা নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে যান দূরদূরান্তের লোকেরা। যে কারণে পূর্বের নামমাত্র মূল্যেই ইজারা ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এবারও গুঞ্জন উঠেছে হাত বদল হলেও কৌশল বদলের সম্ভাবনা খুবই কম। নিকুজিশনের সম্ভাবনাই বেশি রয়েছে।
ঐতিহাসিক ও ব্যাপক এ হাটটি ঘুরে সরেজমিনে দেখা মিলে গরুর হাটের আড়ালে চলে সপ্তাহের শনিবার ব্যতীত অন্যান্য সময়ে সাবলীজ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই চলে এখানকার ব্যবসা। বৃষ্টির মৌসুমে পানি সরানোর ড্রেইনের অকার্যকর থাকায় দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরা ছাড়া বিকল্প কোন উপায়ও থাকে না। পানি জমাটবদ্ধ হয়ে নোংরা কাদাতে পরিণত হয়ে উঠে অধিকাংশ জায়গা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে হাটের দিনে। যুগে যুগে স্থানীয় নেতাকর্মীরা সুবিধা নিলেও উন্নয়নের দেখা মিলেনা এই বাজারে। এ নিয়ে ইজারাদার, সভাপতি ও বাজার কমিটির বিরুদ্ধে সীমাহীন সমালোচনা থাকলেও ইজারাদার মহিউদ্দিনের ভাষ্য, প্রায় ১৮বছর ইজারা নিয়েছেন সত্য তবে ৭% টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে চলে যায়। বাকীটা স্থানীয় রাজস্ব খাতে। উপজেলা উন্নয়ন কমিটির দায়িত্বে থাকারা হাটটির দিকে নজর দেয়নি বলেই উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। তবে সিডিউল বানিজ্যের বিষয়টি মহিউদ্দিন একেবারেই অস্বীকার করেছেন।
বাজিতপুর উপজেলা অফিস সূত্র নিশ্চিত করেছেন ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০টির অধিক সিডিউল বিক্রি হয়েছে। ২০ তারিখে সিডিউল ড্র হবে। শুধু গরুর হাট নয় সামগ্রিকভাবেই বাজারটিকে বাৎসরিক ইজারা দেয়া হয়। ৩ বছরের গড়ের সাথে শতকরা ৬ ভাগ টাকা জমা হয়। গত ২০২৪ সালে বাজারটির ইজারা মূল্য ছিলো ৪৩ লক্ষ ১০০ টাকা। অফিস সূত্র আরও জানায় ইজারার এ টাকা থেকে ৪১% চলে যায় উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিলে, ১৫% বাজারের উন্নয়নে, সরকারি ও চৌকিদারের বেতন বাবদে ১২%, ইউনিয়ন পরিষদকে দেয়া হয় ১০%, এছাড়াও মুক্তি যোদ্ধাদের জন্যে ৪%সহ অন্যান্য খাতের কথা উল্লেখ করা হয়। বাজারটির অধীনে রয়েছে কাচা বাজার, মাছ ,পাট মহল, সরিষা, চাউল, মোদী, ভ্রাম্যমান দোকানসহ হাস মুরগী, গরু ও ছাগলের পৃথক পৃথক মহল। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার এ হাটের সুনাম ছিলো মুগল, বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই। গোটা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জুরেই এর খ্যাতি। এ বাজারে সপ্তাহের শনিবারেই বসে গরুর হাট। এলাকার নাম অনুসারেই এ হাট-বাজারটির নাম করণ করা হয়েছে। জেলার প্রায় অর্ধেক উপজেলার অধিক পশু ক্রেতা বিক্রেতাদের সমাগম এ হাটে। এছাড়াও পশু কেনা বেচার উদ্দেশ্যে শনিবারে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে থাকেন। তবে সেই বাজারের ঐতিহ্য নজরদারীর অভাবে চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। আশেপাশের নিকলীর জারইতলার আঠার বাড়িয়ার গরুর হাট হয়ে উঠেছে তুলনামূলক অনেকটা জমজমাট। সিন্ডিকেটের কারণে কোটি টাকা ইজারা মূল্যের বাজার নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিলেও উন্নয়নের পথেও রয়েছে নানান অন্তরায়। সরারচর বাজার গরুর হাটের ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে দোকান বানিয়ে সাব-লিজ দিয়েও বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও স্থানীয়ভাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসংখ্য ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে আক্ষেপের সুরে বলেন, ইজারা মূল্য প্রতিবছর কাছাকাছি থাকলেও ভাড়া নিয়মিত বেড়েই চলেছে। দুঃখের বিষয় পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই। গরুর হাটের নোংরা ড্রেইনের আশেপাশে দুর্গন্ধ সত্বেও ষশনিবারের হাটের দিন ব্যতীত সাবলীজে বসে ৮৬টি দোকান। রাখা হয় প্রায় ৮০টি মালবাহী লড়ি ও ট্রাক।
সরারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান স্বপন জনান, ঐতিহ্যবাহী এ বাজারে ছোট-বড় সব মিলে প্রায় ১ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। এছাড়াও সপ্তাহের শনিবারে বসে ভ্রাম্যমান দোকানীরাও। তবে উন্নয়ন ও নিকুজিশনের প্রশ্নে চুপসে যান।
সরারচর ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী মাহফুজ হাসান জানান, ৩ একরের অধিক পরিমাণের সরারচর বাজারে মোট চান্দিনা ভিটির সংখ্যা ৬৫টি। বাজারটি মজলিশপুর মৌজায় পড়েছে ২৮৬ দাগে ১ একর ৭৭ শতাংশ। বাকী মিরাপুর মৌজার ৭৯ দাগে ১ একর ২৬ শতাংশ।
বাজিতপুর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা ফারাশিদ বিন এনামের কাছে সিন্ডিকেট বানিজ্য বিষয়ে জানতে চাওয়ার জবাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, যদি কেহ বাজার ইজারা নিতে প্রস্তুত থাকেন সেক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে সহযোগিতার কোনোই কমতি থাকবে না। জেলা উপজেলার একাধিক স্থান থেকে সেই সুযোগ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিজাবে রহমত বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে সরকার রাজস্ব হারাবে এটা কখনোই হতে দেয়া যাবে না। তাই এই বিষয়ে সদা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আপনার মতামত লিখুন :