বৈজ্ঞানিক গতিশীলতার পাশাপাশি গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খেলাধুলা ও কল্পকাহিনীর চর্চা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে জানান সংস্কৃতি মনারা। এসব চর্চা শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকে উপকারী বলেও যুক্তি তুলে ধরেন। জেলা ক্রীড়া অফিস সূত্রের ভাষ্যমতে আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও কলাকৌশলই এর জন্যে প্রধান দায়ী। বিনোদনকে সতেজ রাখতে হলে সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে জুড়ালো কার্যকর ভূমিকার বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করা হয়। তবে অসংখ্য বিনোদন প্রেমিরা হতাশায় ভেঙে পড়েন অতীতের অনেক বিনোদন হারানোর দৃশ্যে।
কিশোরগঞ্জের নিকলী বাজিতপুর অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও তৎসংলগ্ন হাওর অঞ্চলগুলোতে সরজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অতীতের অনেক ধরণের বিনোদন ও খেলাধুলা বর্তমানে হারাতে বসেছে এমনকি অতলে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামীন হরেক গ্রামীণ সংস্কৃতি।
কিশোরগঞ্জের নিকলীর জারইতলা স্কুল এন্ড কলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ১৬ ডিসেম্বর মতো বিজয় দিবসের স্মরণীয় দিনে জাঁকজমকপূর্ণ বিনোদনের প্রস্তুতির অভাবের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রবীণ অসংখ্য শিক্ষার্থীদের ভাষ্য আগেকার দিনে জাতীয় বিজয় দিবসকে উচিলা করে খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের আয়োজন করা হতো। তবে একজন প্রধান শিক্ষকের ভাষ্য সরকারি বিধি মোতাবেকই নিয়ম পালন করা হয়ে থাকে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে জাতীয় খেলা কাবাডি হলেও এখন আর গ্রাম-গঞ্জে এ খেলার দৃশ্য তেমন একটা চোখে পড়ে না। হাওর অঞ্চলের অনেক শিশুরাও কাবাডি খেলা সম্পর্কে ধারণা ভূলে গেছে। এমনকি অনেকের বাস্তবে দেখা মেলেনি এ খেলার। কাবাডি খেলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই তাদের উত্তর মিলে এটা কিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবে স্থান পেয়েছিল যেখানে তৃণমূলে যার চর্চাই নেই! এটা অদ্ভুত কোন প্রশ্ন নয়, অনেক শিশুর মাঝেই এ কৌতুহল। সচেতন মহলের ভাষ্য, বহির্বিশ্বে জাতীয় এই খেলার সুনাম ধরে রাখতে হলে শহরে-নগরে, গ্রাম-গঞ্জে সর্বত্র এ খেলাকে গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য দিতে হবে। এমনি মতামত ব্যক্ত করেন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিকমনারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে গ্রাম থেকে হারাতে বসেছে বিভিন্ন ধরণের খেলা। আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন নামে এসব খেলার মধ্যে কিশোরগঞ্জের ভাষায় যাদের মধ্যে ধারিয়া বান্ধা, গোল্লাছুট, কানামাছি আর মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ খেলার মধ্যে পুতুল খেলা, ছিকুত খেলাসহ অনেক ধরণের খেলা।
তুলনামূলক কমে গেছে ভলিবলের প্রচলন, টেনিস, এমনকি গ্রামের বিয়ে বা খতনার অনুষ্ঠানে দেখা যায় না লাটিখেলার দৃশ্যও।
গ্রামের বয়স্ক লোকেরাও এখন আর আগের মতো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়ে এ সব খেলা দেখার জন্যে ভীড় জমায় না। এসবের জন্য দায়ী আধুনিক স্মার্টফোনসহ ও বিভিন্ন ধরণের ডিভাইস। উপার্জনের নেশায় ছুটে চলা শিশু কিশোরদের বিনোদনের পথে বাধা।
হাওর অঞ্চলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আফসোসের সুরে কয় গ্রামে এখন আর চোখে পড়ে না মাঝিদের পালতোলা ডিঙ্গি নৌকার দৃশ্য। যেখানে মাঝিরা মনের আনন্দে হেসে খেলে গেয়ে বেড়াতেন ভাটিয়ালি জারি সারি গান। চাঁদনী রাতে উঠুনে এখন আর জমে উঠে না কিচ্ছা ও পুতি পালার গান। যাত্রা পালা ও একাংকীকা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। সকালের আড্ডার চলে বিভিন্ন ধরণের হুক্কায় তামাক খাওয়ার চলে মুরব্বিদের একত্রিত হওয়ার দৃশ্যও এখন আর সেই রকম চোখে পড়ে না। কমে গেছে বিলের শাপলা ফুলের দৃশ্য। অতীতের মতো এখন আর শালুক আর শাপলা তোলার চলে সাতার কাটার দৃশ্যও চোখে পড়ে না। মাঠে গরু ছড়ানোর ফাঁকে রাখালের বিভিন্ন ধরণের খেলার দৃশ্য তেমন একটা চোখে পড়ে না। অনাবাদি মাঠ এখন আবাদ হয়ে গেছে। গ্রামের সৌখিন লোকদের ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতা এখন নেই বললেই চলে। আগের মতো বর্ষার টলমলে জলে উপভোগের সুযোগ মেলে না নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার।
ঘাটো নৌকা আর ঘাটো গানের কথা এখন যেনো কাল্পনিক। গ্রামে এখন আর কলসি কাঁখে লাজুক নারীদের ঘোমটার দৃশ্য চোখে পড়ে না। এ সব যেনো এখন স্মৃতি। গ্রামের মুরব্বিদের আফসোসের ভাষ্য এই সব স্মৃতি যেনো আজো অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় যান্ত্রিক সভ্যতায় বেড়েছে কোলাহল, বেড়েছে শব্দ দূষণ, বাতাসেও বেড়েছে সিসা। যদিও সহজতর হয়েছে যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক কিছু। তবুও অতীত মৃত নয় অতীত গত। অতীতের এসব স্মৃতি যেনো এখনো কথা কয়।
তুলনামূলক কমে গেছে ভলিবলের প্রচলন, জন সংখ্যার তুলনায় ফুটবলের ইমেজ অনেকটা কমেছে। নিকলীর জারইতলার মতো গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য খেলার মাঠের উপর তৈরি হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি হাট বাজার। সচেতন মহলের ভাষ্যমতে এটি গোটা বাংলাদেশের একটি খণ্ডচিত্র। জায়গার স্বল্পতার পাশাপাশি মানসিকতাও অনেকটা এ জন্যে দায়ী। তাই জারইতলা উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের ন্যায় অসংখ্য খেলার মাঠ তদারকির অভাবে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। তবে নতুন খেলা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট আর এন্ড্রয়েড মোবাইলের নানান গেইম।
সংস্কৃতি মানুষের মনের খোরাক। খেলাধুলা ও বিনোদন মনুষ্য মনকে প্রফুল্ল ও সতেজ রাখতে সহায়তা করে এমন যুক্তি তোলে ধরে জারইতলা স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন বাদল। তবে সরকারি বিধি মোতাবেক তাকে চলতে হয় বলে তৈমন প্রস্তুতিই এবারের বিজয় দিবসে।
কিশোরগঞ্জ জেলার ক্রীড়া অফিসার মো. মাসুদ রানার সাথে খেলাধুলার পাশাপাশি হারাতে বসেছে গ্রামীণ অনেক ঐতিহ্য এমন প্রশ্ন রাখতেই তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন বাস্তবতাকে। তবে শারীরিক বিনোদন দেহ মনকে ভালো রাখলেও এখন আর আগের মতো অনেকে উৎসাহ দেখায় না বলে উল্লেখ করেন। আধুনিক ডিভাইস ও ইলেকট্রিক কলাকৌশলকেই তিনি গ্রামীণ বিনোদনের প্রধান বাধা বলে দায়ী করেন। তবুও তিনি জাতীয় খেলাসহ বিভিন্ন খেলাধুলার ইমেজে ধরে রাখার প্রাণপণে চেষ্টায় আছেন বলে জানান।
আপনার মতামত লিখুন :