বিশেষ প্রতিনিধি: নিকলীতে সরকারের দেয়া আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরে থাকে না অধিকাংশ বাস্তুহারা জনগণ। সরকারি অর্থ ব্যয়ে নির্মিত এসব ঘরে কেন থাকে না এই বিষয়ে তদারকির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলেও সরেজমিনে উঠে আসে। অপরদিকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে প্রকৃত অসহায় বাস্তুহারা জনগণ ভূগছে হাহাকারে। ঘর পাওয়ার পাওয়ার আশায় এখনো ঘুরছে বিভিন্ন মহলের ধারে ধারে। আঠার বাড়িয়ার ভিটেমাটিহীন অসহায় বিধবা ফিরুজা ও তার প্রতিবন্ধী মেয়ে জেসমিনসহ একই গ্রামের মাহম্মদ আলীর ন্যায় অসংখ্য অসহায় দীর্ঘদিন থেকে ঘুরছে বসতভিটে পাওয়ার আশায়।
শুধু বাস্তুহারাদের ঘর তৈরির ক্ষেত্রেই ব্যাপক অনিয়ম নয় বরং স্বজন প্রীতি হয়েছে অসহায়দের বিভিন্ন প্রকল্পের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঘর দেয়ার ক্ষেত্রেও। জানা গেছে ১০ লক্ষ টাকার বাজেটের ন্যায় ঘরেও ব্যাপক স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের বানিজ্য আ’লীগ সরকারের আমলেই হয়েছে। উন্নয়নের নামে স্বজনপ্রীতি আর হরিরলুটের দৃশ্য সর্বত্র। নিকলী উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক আওয়াজের আপন দুই ভাগ্নে সামসুল হক ও কবির আর ভাইপো স্বাজন ৩জন মিলে পৃথকভাবে স্বচ্ছতা সত্বেও ৩টি ঘরের মালিক। নিকলী সদর ষাটধার অবসর প্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য হাসান আলীর ছেলে স্বজন মাহমুদ ও তার ফুফাতো ভাই কামার হাটির অবসরপ্রাপ্ত ভূমি অফিসের সরকারি কর্মচারী ফজলুর রহমানের ছেলে সামসুল হক ও মাঝহাটির রঙ্গু মিয়ার ছেলে ব্যবসায়ী কবির। এদের মতো অনেকেই রাজনৈতিক দাপটে ও স্বজনপ্রীতির বিনিময়ে পেয়েছে অসহায়দের ঘর। বঞ্চিত হয়েছে প্রকৃত অসহায়েরা। স্থানীয়দের অভিযোগ বন্টনে অনিয়মের পাশাপাশি আ’লীগ সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিলো যথেষ্ট পরিমাণে। যে কারণে অনিয়ম হাহাকারের চিত্র চরমে। অনিয়মের বাস্তবতার কথা উপজেলা অফিস সূত্রও ভিন্ন আঙ্গিকে স্বীকার করেছেন।
কিশোরগঞ্জের নিকলীতে বাস্তুহারা নীড় ঘুরে দেখা মিলে ব্যতিক্রমী চিত্র। নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে ঘর দেয়ার কারণে অনেক হচ্ছে নাগরিক কিছু সুবিধা বঞ্চিত। আশেপাশে কর্মক্ষেত্র না থাকায় জীবিকা নির্বাহের তাগিদেও শহরে চলে গেছে। সচেতন মহলের ভাষ্য, সুসম বন্টনের মাধ্যমে প্রকৃত অসহায়দের ঘর দেয়ার পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা দেয়া হলে এমনটি হতো না। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আরও জানা গেছে কিশোরগঞ্জের নিকলী ও আশেপাশের উপজেলারতেও একই অনিয়মের চিত্র। তবে নিকলী উপজেলাতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫টি ধাপে ১৩৭টি ঘরের মধ্যে চলতি সপ্তাহে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অধিকাংশ ঘরের মধ্যে থাকে না বাস্তুহারা জনগণ। সরেজমিনে বসবাসকারীদের সাথে কথা হলে জারইতলা ইউনিয়নের উত্তর জাল্লাবাদ এবং রসুলপুর ও আঠার বাড়িয়া এলাকাতে ৩য় ধাপে নির্মীত ৩৮টি ঘরের মধ্যে মোট বসতি ১৪টি পরিবার। এদের মধ্যে উত্তর জালালাবাদে ২২টি ঘরের মধ্যে অবস্থান করতে দেখা গেছে ৯টি পরিবার, রসুলপুর বাজারের সংলগ্নে ৫টির মধ্যে ২টি, উত্তর জালালাবাদ গ্রামে শেষের দিকে নির্মিত অপর ৭টির মধ্যে রয়েছে ২টি পরিবার। আঠার বাড়িয়াতে ৪টির মধ্যে ১টি পরিবার। উত্তর জালালাবাদে বসবাসকারী নাজমা বলেন, ৭টি পরিবারের মধ্যে ২টি পরিবার নিয়মিত থাকে। বাকীদের কখনো দেখা মিলে না। এখানে বসবাসকারীদের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগও নেই বলেও উল্লেখ করেন। এই বিষয়ে নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার সাথে কথা হলে অচিরেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেন।
নিকলী সদর হতে আগত জারইতলার উত্তর জাল্লাবাদে বাস্তুহারায় বসবাসকারী শরিফা আক্তার বলেন, এখানে বসবাসের কারণে তাদেরকে বেশ কিছু নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। বিশেষ করে কর্মদক্ষতা তৈরির ক্ষেত্রে দলগতভাবে ক্ষুদ্র ঋণ না পাওয়া থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকারের সুযোগ-সুবিধা হারাচ্ছে বলে দাবি তোলেন। এছাড়াও ঋণ উত্তোলনের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতার প্রশ্নে সুবিধা বঞ্চিত হয়ে থাকে। তবে স্থানীয় সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ভাষ্য বিষয়টি অচিরেই খতিয়ে দেখা হবে এবং এনআইডি সংশোধনের বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ২০২৩-২৪ অর্ছ বছরে সামাজিক ও প্রান্তিক নিরাপত্তায় ১৭টি কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষা উপবৃত্তি ও বিভিন্ন ভাতাসহ আর্থিক অনুদান বাবদ ৩৪ লক্ষ ৭৯৭ জন উপকরণভোগীর মধ্যে ১১ কোটি ৮৪ লক্ষ ৩৩ হাজার ৯৭ টাকার আর্থিক লেনদেন হয়। এছাড়াও সমাজসেবার অধীনে দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রামের আওতায় ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণে স্বাবলম্বীর লক্ষ্যে ১,৪৮,৬১,৯৬৫ টাকা ৪৭৭৫ জনকে দেয়া হয়। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন এনজিওসহ মোট ২০টি প্রতিষ্ঠান লোন ফাংশন নিয়ে কাজ করলেও বাস্তুহারাদের অভিযোগ তারা এখানে অবস্থান করায় অনেকগুলো সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রতিয়মান হয় যে, প্রতিটি মানুষই তার জন্মভূমি তথা জন্মস্থানকে ভালবেসে সমগ্র জীবন কাটাতে চায়। ব্যতিক্রমী হয়ে উঠে তখনি যখন ব্যক্তি তার নিজ এলাকায় নানাবিধ কারণে অধিকার হারায়। কেউ অধিকার বঞ্চিত হয়ে এলাকা ছাড়ে। কেউ সুখের আশায় এলাকা ছাড়ে। ঠিক তেমনি প্রকৃত বাস্তুহারা জনগণও সুযোগ পেলে এলাকাতেই থাকতে চায়। সুযোগসীনায় ঘর ছাড়ে বলেও উল্লেখ করে।
নিকলী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাওয়ার জবাবে ৫টি ধাপে নির্মিত ঘরের মধ্যে প্রথম দিকে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা থাকলেও সর্বশেষ বাজেটে ভ্যাট ট্যাক্স বাদে দেয়া হয়েছে ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা করে। এছাড়াও অনিয়ম এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকার বিষয়টি এক পর্যায়ে স্বীকারও করেন।
নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকতা পাপিয়া আক্তার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঘরে না থাকার কারণ তারা খুঁজে দেখবেন। যদি দীর্ঘ সময়ে না থাকে তাহলে বিধি মোতাবেক বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান। তবে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিতের বিষয়ে খতিয়ে দেখছেন এবং সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সাথেও যোগাযোগেরও পরামর্শ প্রদান করেন।
আপনার মতামত লিখুন :