Agaminews
Dr. Neem Hakim

হাওর অঞ্চলে মৎস্য ও পরিবেশ বিপর্যয়!


দৈনিক আমার খবর প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ২৫, ২০২৫, ৮:৩৭ অপরাহ্ন /
হাওর অঞ্চলে মৎস্য ও পরিবেশ বিপর্যয়!

হাওর অঞ্চল থেকে বিশেষ প্রতিনিধিঃ মৎস্য খেকো দুর্বৃত্তায়ন ও বিভিন্ন মহলের অসচেতনতার দরুণ পানি ও পরিবেশ ব্যাপক হুমকির মুখে। নজরদারির অভাবে প্রকৃতিক বিপর্যয়ে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যহীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে কৃষিসহ হাওর অঞ্চলের ১২টি সেক্টরের সমন্বয়ে কাজের বিকল্প নেই বলেও দাবি তোলেন এই সব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। এই বিষয়ে সচেতন মহলের ভাষ্য জনসচেতনতা ও প্রসাশনের তদারকিই পারে একমাত্র এই বিপর্যয় ঠেকাতে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়িসহ সব মিলিয়ে ৪৯ লক্ষ ১৪ হাজার ৭১৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। ৭১ হাজার ৪৪৭ হাজার মেট্রিকটন রপ্তানি হয়। যার সার্বিক মূল্য ৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে ৫ম স্থানের কথা বলা হলেও এ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

স্বার্থপর মানুষগুলো স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার দরুণ প্রকৃতির উপর জুলুম করে। প্রতিশোধ রূপে প্রকৃতি তার আবহাওয়ার তারতম্য ঘটিয়ে সকল মানুষ ও প্রাণীকুলকে শাস্তি দেয়। আসাধুরা আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েও নানান অপকর্মে লিপ্ত থাকে বলে হাওর অঞ্চলের জেলেও কৃষক শ্রেণীর মানুষের কাছে থেকে এই মৌসুমে অধিক পরিমাণে অভিযোগ ও তার সত্যতা মিলে।

ষড়ঋতুর এদেশে হাওর অঞ্চলের বর্ষার চিত্র হয়ে থাকে অনেকটা ব্যতিক্রমী। বর্ষা তথা ঠিক পরবর্তী সময়ে পানি শুকিয়ে যাওয়ার মৌসুমে অসংখ্য জেলে পরিবার মাছ ধরার কাজে ব্যস্ততার মাঝে সময় পাড় করেন নদী ও বিলের বুকে। এমনি বাস্তবতা মিলে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলাসহ আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলা এবং পাশাপাশি সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরগুলোতে।

কিশোরগঞ্জের প্রবাহমান একটি নদীর নাম ঘোড়াউত্রা। সিলেটের উত্তর পূর্ব সিমান্তের বৃহৎ নদীর নাম সুরমা। যেটি উজানের ভারত থেকে নেমে এসেছে বাংলাদেশে। জকিগঞ্জের বরাক মোহনায় এর উৎপত্তি। সেখান থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে দুটি ভাগে একটি সুরমা অপরটি কুশিয়ারা। সুরমা নদীটি সুনামগঞ্জ থেকে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোনা জেলার কালিয়াজুড়ি হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায় প্রবেশের পর প্রবাহিত হয়েছে ধনু নদী নামে। এটি মিঠামইন ও নিকলীতে এসে ঘোড়াউত্রা নাম ধারণ করে বাজিতপুরের উপর দিয়ে কুলিয়ারচরের কাছাকাছি গিয়ে পতিত হয়েছে মেঘনায়। প্রবাহমান এই নদীর শাখা ও উপশাখার চতুর দিকে অসংখ্য খাল-বিলের ছড়াছড়ি। এসব আবার মাছের বিচরণ ক্ষেত্রের পাশাপাশি বংশ বিস্তারেরও উপযুক্ত স্থান। বর্ষায় বেড়ে যায় এর ব্যাপকতা। উপদেষ্টা মন্ডলী ও গবেষকদের দাবি হাওর অঞ্চলে কৃষিজ, পরিবেশ, এলজিইডিসহ মোট ১২টি সেক্টরের সমন্বয়ে মৎস্যের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করলেই ঠিকে থাকবে মাছের বংশ বিস্তার।

অনুসন্ধানে বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ আর ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের সন্ধান মিলেছে। এছাড়াও ডজনের অধিক পরিমাণে ভিনদেশী মাছ চাষসহ ৭০টির অধিক বাহারি প্রজাতির বিদেশি মাছ এ্যাকুয়ারিয়ামে মিলেছে। যদিও এই তথ্য কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আইইউসিএন (২০০৩) সালের তথ্যানুসারেই বাংলাদেশে স্বাদুপানির ৫৪ প্রজাতির মাছ হুমকির সম্মুখীন। বর্তমানে এর সংখ্যা আরও বাড়তির দিকে।

তবে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জানা গেছে আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে জেলেদের সংখ্যা, কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিক মাছের সংখ্যাও। অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে এ দেশের মিঠা পানি থেকে। তবে তুলনামূলকভাবে বেড়েছে বহুগুণে চাষের মাছের সংখ্যা। যে কারণে বর্তমানে মাছ রপ্তানি কারক দেশ হিসেবে গত বছরেও পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫মে। যদিও এ তথ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে সর্বজনীন স্বীকৃত এ দেশের মিঠাপানির প্রাকৃতিক মাছ অত্যান্ত সুস্বাদু আর কদর ও সুনাম পৃথিবীর নানান দেশে।

এদিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক মাছ কমে যাওয়ার পিছনে নানাবিধ কারণ নিয়ে। এসব কারণের মধ্যে অন্যতম দায়ী করা হচ্ছে সাজানো মৎস্যজীবী সমিতির নামে নামধারী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীরা জেলে সেজে হাওর অঞ্চলের নদী-নালা, খালে-বিল ইজারা এনে অনৈতিকভাবে মাছ আহরণ করে। অসাধুরা নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাঁধ দিয়ে মেশিন দ্বারা পানি সেচে মাছ ধরে থাকে। এতে মাছের বংশ বৃদ্ধি নষ্ট হচ্ছে। অভিযোগেও থেমে নেই এসব দৃশ্য‌। দিশেহারা হচ্ছে প্রকৃত জেলেরা। যে কারণে জেলেদের অনেকে বাপদাদার এ পেশা ছেড়ে দিতেও বাধ্য হচ্ছেন।

 

লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে নিকলীতে প্রতিবছরের ন্যায় চলতি মাসেও সেচ মেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরেছেন মৎস্য খেকো দুর্বৃত্তরা। উপজেলা প্রসাশন সূত্রে তথ্য মিলে।

সরেজমিনে অভিযোগ উঠেছে শাখা ও উপশাখা নদ-নদী হতে সৃষ্ট খাল বিলে এই মৌসুমে পানি টইটম্বুর থাকলেও চলতি বোরো মৌসুমের আগেই নিকলীর ছালতাতলা নদীর মতো অসংখ্য নদী-নালার বুকে পানি নেই। নদ-নদীর আশেপাশের শতশত একর আবাদি জমি সমস্যায় পড়বে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিশোরগঞ্জের নরসুন্দার বিভিন্ন অংশে এবং তার শাখা-উপশাখাসহ ঘোড়াউত্রার শাখা উপশাখার বেশ কিছু অংশের ন্যায় হাওর অঞ্চলের অসংখ্য নদীর বুকে বোরো আবাদ দেখা গেছে। অপর দিকে কোন কোন হাওরের পানি এখনো সরছে না বলে হাহাকারে রয়েছে। এসবের জন্যে খননের অভাবই দায়ী। মৌসুমে বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেলেই সেই সব স্থানের বোর আবাদও পড়ে হুমকির মুখে। অপরদিকে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্রও সংকীর্ণ হয়ে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে স্থায়ীভাবে মাছের অভয়াশ্রম না থাকা, হাওরে ক্ষতিকর চায়না জালের ব্যবহার, ইলেকট্রিক শক, বর্ষা মৌসুমে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন, বোরো ধান রক্ষায় অপরিকল্পিত বাধ নির্মাণের জন্য মাছের প্রজননে বাধাগ্রস্ত করা। ধানের রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য অতিমাত্রায় কীটনাশকের প্রয়োগও হাওরের মাছ কমে যাওয়ার কারণ। এছাড়াও রয়েছে নানাবিধ অম্লধর্মীয় অক্সাইড বা এসিড মিশ্রিত থাকার কারণ। এসিড বৃষ্টির কারণে পানিতে অম্লতা বাড়ে। পৃথিবী বর্তমানে খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে আর এর অন্যতম কারণ শিল্প বিপ্লব। বর্তমানে ব্যাপক হারে শিল্প কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে। সেই সাথে কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণের মাত্রাও দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্প কারখানা স্থাপনের ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং সেই সাথে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সাথে এসিড বৃষ্টির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসিড বৃষ্টির কারণে জীবের ক্ষতি হতে পারে বা জীব মারাও যেতে পারে। মাছ তাদের অন্যতম ঝুঁকির শিকার। মাটির অম্লত্ব (Acidity) হল মাটির মধ্যে হাইড্রোজেন আয়নের (H⁺) পরিমাণ বেশি থাকা অবস্থার ফল। পিএইচ স্কেলে এর মান ৭-এর নিচে থাকে। অম্লবৃষ্টি, পাতা ও অন্যান্য জৈব পদার্থের পচন এবং কিছু রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণেও মাটির অম্লত্ব বাড়ে। তবে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, কম বৃষ্টিপাত, কীটনাশক ও অতিরিক্ত সারের প্রয়োগ মাটির ক্ষারত্বও বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে হাওরের বিশাল জলরাশিতে ক্ষার ও অম্লতা দূর করা অনেকটা কঠিন বলেও উল্লেখ করেন হাওরের জেলেরা। যে কারণে মাছের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়ে থাকে।

সরেজমিনে হাট-বাজারগুলোতে অবাধে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছের দৃশ্য ধরা পড়ে। অবাধে বিক্রি হচ্ছে রেণু পোনাও। ‘মাছের প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে ও উৎপাদন বাড়াতে অবশ্যই পোনা মাছ এবং ডিমওয়ালা মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে ক্ষতিকর জালের ব্যবহারও। এছাড়াও যে সব নিচু জমিতে বোরো আবাদ হুমকিতে সেখানে মাছের চাষ করতে হবে। শাখা উপশাখার নামে প্রবাহমান নদী লীজ বাতিল করতে হবে। প্রকৃত জেলেদের সুযোগ দিতে হবে এমন আশা ব্যক্ত করেন সচেতন মহল।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বিলুপ্ত প্রায় হাওর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় রাণী মাছ, বেদরে মাছ, পাটের শাড়ী, ইটা মাছ,বাচা মাছ, পাবদা মাছ, কাক্কে , শোবল মাছ, গুতুমসহ বেশকিছু প্রজাতির মাছ।

বাজিতপুর হিলোচিয়া জেলে পাড়ার ৬০ উর্ধ্ব সন্ধ্যা রানীর আফসোসের ভাষ্য, এক সময়ে সারা বছর নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করতে পারতেন। ইজারার কারণে এখন নদীতে মাছ ধরার সুযোগ নেই বলে জানান।

 

কিশোরগঞ্জের রোদারপুড্ডার মৎস্যজীবী শফিকুল ইসলামের আফসোসের ভাষ্য, চলতি মৌসুমে মাছের বাজার দর ভালো থাকলেও ব্যাপক লসের সম্ভাবনা রয়েছে। লীজের টাকা তোলা নিয়েই সংশয়ে আছে বলে উল্লেখ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন মাছের সংখ্যাও তুলনামূলক কম আর আকৃতিও ছোট। তিনি আরও উল্লেখ করেন প্রাকৃতিক তারতম্যের কারণে পানি আগমন দেরি ও দ্রুত প্রস্থানের ফলে অনেকটা এমন হচ্ছে। এছাড়াও দায়ী করেন অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহারকে।

 

নিকলী সদরের মৎস্যজীবী সুলতানের ভাষ্যমত বদ্ধ জলাশয়ে অতিরিক্ত শীতে চাষের বৃদ্ধি কমে গেছে। এছাড়াও ঘোড়াউত্রা নদীর মুখে বোরোলিয়ার খাল ও ষাটধার পাটি বাঁধের মতো অসংখ্য হাওরের নদী ও খালে পলিতে ভরাটের কারণে সহজে ইজারাদারেরা বাঁধ মাধ্যমে মেশিন দিয়ে সেচে মাছ নিধন করছে।

 

কিশোরগঞ্জের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের তথ্যমতে, হাওর অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহন করা হচ্ছে বলে জানান । এছাড়াও ইটনাতে ২১ ডিসেম্বর উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান হাওরে পরিদর্শনে এসে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন স্থানীয় এ সেক্টরে। হাওরে মাছের বংশবৃদ্ধি নিয়েও কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

 

পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মু: সোহরাব আলিকে ৩০ ডিসেম্বর একাধিকবার ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি। সদর দপ্তরের প্রধান পিএ সেকেন্দার দাড়িয়াকে বাংলাদেশে কি পরিমান এসিড বৃষ্টি হয়। এর জন্যে দায়ী কি? এমন প্রশ্ন রাখতেই মিটিংয়ে থাকার অজুহাতে জবাব এড়িয়ে যান। তবে কিশোরগঞ্জের দায়িত্বে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মমিন ভূঁইয়া বলেন, পরিবেশ দূষণের জন্যে দায়ী সবধরনের কালো ধোঁয়া। এর কুপ্রভাব প্রকৃতির উপরে পড়ে বলেও তিনি স্বীকার করেন।